শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৮ পূর্বাহ্ন
মোস্তফা কামাল:
কোথাও মার, কোথাও ধরের শিকার সাংবাদিকরা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ধরা হয়েছে সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে। মামলা দিয়ে ধরা হয়নি তাকে। ধরার ঘণ্টা কয়েক পর মামলা দেওয়া হয়েছে। এরপর জেল থেকে জেল। কেরানীগঞ্জ টু কাশিমপুর; কাশিমপুর টু কেরানীগঞ্জ। নানা নাটকীয়তার পর ২০ হাজার টাকা মুচলেকায় শর্তসাপেক্ষে জামিন। আর তার সম্পাদক মতিউর রহমান হাজিরা দিয়ে ৬ মাসের আগাম জামিন পেয়েছেন। তাকে জামিন না দিলেই কি অনেক কিছু হয়ে যেত? সাংবাদিকরা দেশে উথাল-পাথাল অবস্থা করে ফেলতেন?
সরকারি পর্যায়ে সাংবাদিক ধরার মধ্যেই বিরোধী দল বিএনপি দিয়েছে আস্ত মার। রাজধানীর মিরপুরে তাদের ইফতার পার্টির সংবাদ কাভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের মেরেছে দলের আতিপাতিরা। তাও দলটির মহাসচিবের সামনে। মহাসচিব এ ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন। আবার ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন ক্ষমতাসীন দলকে। সরকারি দলের লোকেরা নাকি বিএনপির ইফতার পার্টিতে ঢুকে গণ্ডগোল পাকিয়ে সাংবাদিকদের মার খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। যুক্তি এবং অজুহাত কত টনটনে!
‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’ বলে দেশে একটা মেঠোকথা চালু আছে। এই ওষুধটির চরম প্রয়োগ হচ্ছে সাংবাদিকদের ওপর। আজ এখানে, কাল সেখানে। বাদ পড়ল না সংযমের আনুষ্ঠানিকতার রমজানেও। এমন উত্তম-মধ্যম খেতেই থাকবেন সাংবাদিকরা? কেন? কী অসুখ হয়েছে তাদের? কোনো অসুখ যদি হয়েও থাকে আর কোনো ওষুধ নেই? মাইরই একমাত্র ওষুধ? কারা এ ওষুধের প্রেসক্রাইবার?
গেল রমজানেও ঢাকার নিউ মার্কেটের কর্মচারী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় এ খাদ্যই জুটেছে সাংবাদিকদের নসিবে। কেন বাছাই করা হলো সাংবাদিকদের? তারা সংঘর্ষ ও হত্যায় জড়িত মুখঢাকাদের তথ্য-ছবি প্রকাশের অপরাধটি করেছে। এর আগে, ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও ‘হেলমেট বাহিনী’ সাংবাদিকদের আচ্ছা মতো পিটিয়ে তক্তা বানিয়েছে।
কোনো কোনো পেশার ওপর ফুলের টোকা পড়লেও ‘কত ধানে কত চাল’ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তীব্র প্রতিবাদের সক্ষমতা রয়েছে অন্য কিছু পেশাজীবীরও। ব্যতিক্রম কেবল সাংবাদিকরা। ঢাকাসহ দেশে সাংবাদিকদের প্রায় শ-দেড়েক সংগঠন রয়েছে। দেড়শো সংগঠনের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি এক হলেও তিনশো সাংবাদিক সমাগম হওয়ার কথা। কিন্তু, বাস্তবে ব্যানার টান দিয়ে ধরে রাখার লোকও মেলে না। এখন আর ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমে কষ্ট করার পর্বও নেই। সেই কাজ ভার্চুয়ালিই করে দেওয়া হচ্ছে। বিবৃতি বা বক্তব্য পাঠিয়ে প্রতিবাদের কঠিন কাজটি সেরে ফেলা হচ্ছে সহজে।
কেন এমন নিপাতনে সিদ্ধ হচ্ছে এই কমিউনিটিটি? গণমাধ্যম বিকলাঙ্গের এ আলামত দহন করে না পেশাদারদের? পেশার ভেতর অপেশা ও সংগঠনের অন্তরালে অসংগঠিত দশা কোথায় নিচ্ছে আমাদের? আলামতে চুপ থাকাও একটি প্রতিক্রিয়া। নীরবতার ভাষাও বুঝতে চান না গদিনশীন বড়রা। মাইরের ভাগটা বেশি পড়ে পেশাদার ও মাঠে কাজ করা সাংবাদিকদের ভাগ্যে। তারা কি নিজেরা নিজেরাও মাঝেমধ্যে বসতে পারেন না? উদ্দেশ্য রিপোর্ট করে মানুষকে জানানো নয়, নিজেদের বোধবুদ্ধি শেয়ার করা। নিজেদের প্রশ্ন করা আমরা কি কেবল পুলিশ-র্যাব, নেতা, মন্ত্রী, আতিপাতিদের সংবাদ সম্মেলনের খবর রচনা করব? ‘তিনি বলেন, তিনি জানান, তিনি আরও মন্তব্য করেন, হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন’ ধরনের গৎবাঁধা বয়ানকারী হয়েই থাকব? আর মাইর নামের মহৌষধ খেতেই থাকব?
কেউ মাঠে মার খাবেন, কেউ নানান জায়গায় দাওয়াত খাবেন। এই দাওয়াত খানেঅলাদের মতলব, ব্যক্তিত্বের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, ব্যাস-ব্যাসার্ধ তো মারনেওয়ালারা ভালো মতো বুঝে ফেলেছে। সাংবাদিকদের মারা, ধরা, নাজেহাল করা একদম সোজা কাজ তাদের কাছে। যার যখন মন চায় এ সম্প্রদায়কে পেটাচ্ছে। প্রাণেও মারছে। এতে তেমন কোনো বাধা আসে না। সাংবাদিক মারতে-ধরতে ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন সবার দুয়ারই খোলা। কমজোরিরাও তা ঘটিয়ে দিচ্ছে। এরা জেনে গেছে, সাংবাদিকদের মামলা, আজেবাজে মন্তব্য, পথে-ঘাটে নাজেহাল করলে কিছুই হয় না, হবেও না।
ক্ষমতাবানদের কখনো বুঝের কমতি হয় না। তেলের ক্রাইসিস হয় না। তেলামাথায় তেল ভূতেও জোগায়। সাংবাদিকরা কেন ওই পালে ভিড়ে মালিশ-পালিশে মত্ত থাকবেন? মতলব হাসিলে বিদ্যা-শিক্ষা, সততার বিকল্প হিসেবে তেলের ব্যবহার নতুন নয়। এ সত্যকে রস-সুধায় একশোরও বেশি বছর আগে সাহিত্য মর্যাদা দিয়ে গেছেন পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। বিখ্যাত ‘তৈল’ প্রবন্ধে তা সবিস্তারে লিখে গেছেন তিনি। সেখানকার কয়েকটা লাইন উল্লেখের লোভ সামলাতে পারছি না।
‘…যে সর্বশক্তিময় তৈল ব্যবহার করিতে জানে, সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সব কাজই সোজা, তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না, উকিলিতে প্রসার করিবার জন্য সময় নষ্ট করিতে হয় না, বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোনো কাজেই শিক্ষানবিশ থাকিতে হয় না। যে তৈল দিতে পারিবে তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে, আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্নর হইতে পারে।’
১৯৩১ সালের ১৭ নভেম্বর লোকান্তরিত হওয়া শাস্ত্রী মহোদয় এখনো বেঁচে থাকলে সাংবাদিকদের তেল মালিশ-পালিশবাজ, তস্কর, চাটুকার, মোসাহেবদের অপ্রতিরোধ্য হাউকাউ দেখে কষ্ট পেতেন। আরও কিছু লিখে ‘তৈল’ প্রবন্ধটিকে আপডেট করতেন। ওই প্রবন্ধে তিনি উকিল, প্রফেসর, ম্যাজিস্ট্রেট, গভর্নর, সেনাপতিদের কথা লিখেছেন। বাদ ছিল সাংবাদিকদের কথা। তাদের হাতে না জাতির কল্যাণে সত্যের ঝাণ্ডা তুলে ধরার মহান দায়িত্ব? জাতির বিবেক বুঝি দুস্থ-অসুস্থ, অসহায়-অথর্ব হয়? কেন তারা মোসাহেবিতে আন্ধার গলিতে তেলের ঘানি টানবেন?
হোক না জি-হুজুরদের হুজরতি সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বেশিরভাগ মানুষই অকপটে মিথ্যা বলেন। এগুলোর শ্রোতাও অনেক। সত্য কথার চেয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে মিষ্টি মিথ্যার বাজার বেশি। সাংবাদিকদের কি তা মানায়? সাংবাদিকতা অবশ্যই অন্যসব পেশার চেয়ে একটু আলাদা।
বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সে রকম মোচড় দিয়ে ওঠার অবস্থাও শেষ হওয়ার পথে। তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কষ্ট পেলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। তাদের চাওয়ার ধরনেও ভিন্নতা। এক গ্রুপ এ আইন রাখতেই চান না। আইনটি বাতিলের দাবি তাদের। আরেক গ্রুপ চান আইনটির কিছু ধারা সংশোধনের। এরা সরকারি পছন্দের গ্রুপ। তাদের মাঝেও কয়েক মত-পথ। কারণ তারা ভেতরের অবস্থা বেশি জানেন। ‘আইন (ডিজিটাল) তো সংসদে পাস হয়েই গেছে। এখন এ নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনার কী আছে? ‘পরেরবার ক্ষমতায় এলে দেখা যাবে’ ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন আভাসের পর তারা হাল বুঝে পাল তুলছেন। ঝিম মেরে থাকছেন।
গুজব এবং উসকানিমূলক তথ্যরোধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিহিতের আয়োজন করেছে সরকার। তবে, দেশে জনসম্মুখে মিথ্যা কথা বলে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী রাজনীতিকরা সেগুলোকে সত্য বা ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ বলে চালিয়ে দিলে ধরা খাওয়ার শঙ্কা নেই। ধরা বা মারের পর্বটা কেবল সাংবাদিক নামের নিরীহ জীবদের ভাগ্যে। তাও মুখ চিনে মুগডাল বা মুগুর খাওয়ানোর মতো। এ আইনে গুজবের অভিযোগে নগদে ধরা-বাঁধা, জেল-জরিমানাসহ শায়েস্তা হওয়ার ঝুঁকি এখন সব সাংবাদিকের জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু, পরে কী হবে? ভাগ উল্টে যাবে না তখন? অল্পসংখ্যক কিছু বাদ দিলে রাষ্ট্রের কাছে সাংবাদিকদের মোটাদাগে চাওয়া একেবারে সীমিত। লেখার ও বলার স্বাধীনতা চান তারা। আর রুটি-রুজির নিরাপত্তা। সরকারি কল্যাণ ফান্ডের খবর সবাই জানেন না। রাখেনও না সেই খবর। রুটি-রুজির নিশ্চয়তার মধ্যেই তাদের আসল কল্যাণ নিহিত। তা রাষ্ট্র ও সরকারের জন্যও কল্যাণের। দয়া-দাক্ষিণ্য ধরনের ব্যবস্থা অসম্মানের। সাংবাদিক, সরকার ও রাষ্ট্র সবার জন্যই অকল্যাণের।
অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, নিজেদের অবস্থা-অবস্থান এ জায়গায় এনে ঠেকানোর পেছনে সাংবাদিকরাও দায়মুক্ত নন। বিভিন্ন ইউনিয়ন, ফেডারেশন, বিটের কিছু সাংবাদিক দলীয় কর্মী হয়ে উঠছেন। কখনো কখনো কদাকার দলসেবায় আত্মবিসর্জন দিচ্ছেন তারা। নিজের ওজন কমানোর যাবতীয় বন্দোবস্ত নিজেরাই করতে থাকলে রুখবে কে? বছর কয়েক আগে, এক সাংবাদিককে পুলিশ নাজেহাল করার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, পুলিশ আসলে সাংবাদিকদের নির্যাতন করে না। মাঝে-মধ্যে একটু ধাক্কাধাক্কি করে।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কয়েকবার সাংবাদিকদের সম্বোধন করেছেন রাবিশ নামে। এক সময়ের বহুল আলোচিত সমাজকল্যাণমন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসিন আলী বেশ কবার বলেছেন, সাংবাদিকরা খবিশ। জাতীয় পার্টির মাননীয় রওশন এরশাদ বলেছিলেন, দেশে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় পোলাপাইনগুলো সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে। এমনতর মন্তব্যে বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়, সাংবাদিকদের সম্পর্কে উঁচুতলার কী উপলব্ধি?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন